শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন
লক্ষণীয়, আজকাল ইংরেজি বা বাংলা মিডিয়াম অভিজাত স্কুলই শহুরে নাগরিক সমাজের প্রথম পছন্দ। তাদের সন্তানরা এসব এলিট বিদ্যাপীঠে লেখাপড়ায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, হয়তো খানিকটা গরিমাও বোধ করে। অসহায়, ছিন্নমূল শিশুদের ঠাঁই হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে; অথবা স্রেফ এ বিদ্যালয়গুলো পরিত্যক্ত থাকে অবহেলায়, অনাদরে। রাজধানী থেকে মফস্বল শহর- সর্বত্রই সরকারি স্কুলের এমন রুগ্নদশা।
উদ্বেগের আরও একটা দিক- শিক্ষক, কারিকুলাম বা পাঠ্যবই- মান যাচাই বা নজরদারির অভাবে সব স্কুল মানসম্মত হয়না। অভিভাবক ঝুঁকছে অনেকটাই অন্ধ আকর্ষণে; সামাজিক স্ট্যাটাস বা প্রদর্শনবাদী মনোভঙ্গির তাড়নায়। ফলে মুনাফা শিকারি ব্যবসায়ীর নজর এখন এ বাজারে। কোচিং-গাইড তো আছেই। তবে গ্রামের চিত্র ভিন্ন। এখানে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কিংবা দরিদ্র- সবার আশ্রয় সরকারি এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
স্কুলগুলো তাই সেখানে সতেজ, প্রাণবন্ত। সরকারের সদিচ্ছা-প্রণোদনা বা নাগরিকের সামর্থ্য বৃদ্ধি বা জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণেই হোক- দৃষ্টিভঙ্গির পরিসরে শ্রেণি-লিঙ্গ নির্বিশেষে অন্তত শিক্ষাগ্রহণের প্রশ্নে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। নাগরিক মানসে এ রূপান্তরের সুবিধা নিয়েছে রাষ্ট্র। শিক্ষায় সকল শিশুর অন্তর্ভুক্তি প্রায় শতভাগ। দেশে-বিদেশে এ সাফল্য শুধু প্রশংসিত নয়, রীতিমতো মডেলে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষায় অংশগ্রহণ, সার্বজনীনতা, লিঙ্গসমতা বিশ্বনন্দিত হয়েছে- একথা ঠিক; আবার নতুন চ্যালেঞ্জও এসেছে শিক্ষার গুণগতমান অর্জনের প্রশ্নে। এসডিজি-৪ নির্ধারণ করেছে শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনের লক্ষ্য। পাসের হার সবসময় শিক্ষার মানের যথার্থ নির্দেশক হতে পারে না। সংখ্যা নয়, গুণই হবে শিক্ষার সমকালীন মাপকাঠি। শিক্ষার মানের অর্থেও এখন বদল এসেছে। গতানুগতিকতার জায়গা নিয়েছে দক্ষতা ও জ্ঞান; অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীকে বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তাকে অর্জন করতে হবে ইংরেজি-বাংলায় স্বাচ্ছন্দ্য, যোগাযোগশৈলী, গণিতে পারদর্শিতা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে উৎকর্ষ। শিক্ষার্থী হবে কল্পনাপ্রবণ, সৃজনশীল, বিশ্লেষণাত্মক।
দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৩ হাজার ৬০১ টি। প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বমোট ৩ লাখ ২২ হাজার ৭৬৬ জন শিক্ষক দুই কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করে থাকেন। শিক্ষার মান ও শিক্ষকের যোগ্যতা পরস্পর পরিপূরক। মান নিশ্চিত করেন দক্ষ শিক্ষক। প্রয়োজন পড়ে সঠিক ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ, আধুনিক প্রযুক্তি। আরও গুরুত্বপূর্ণ- সেসব উপকরণ ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জনে চাই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ।
প্রশিক্ষণের ফিডব্যাক ইতিবাচক হচ্ছে কিনা, লক্ষ্য রাখতে হবে । প্রশিক্ষণ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার সুফল উপকারভোগী পাচ্ছে কিনা। এজন্য দরকার তদারকি। দরকার ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা, গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ অতীতের তুলনায় এখন অনেকটা স্বচ্ছ, মানসম্মত। এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ যে, শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ-তরুণীরা সরকারি স্কুলে শিক্ষকতায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। এনরোলমেন্ট বাড়ছে; নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, অভিভাবকের উৎসাহ, রাষ্ট্রের সমর্থন অথবা নাগরিকের সামর্থ্য- যে কারণেই হোক।
প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকের অপ্রতুলতা মানসম্পন্ন শিক্ষাসেবাকে সার্বজনীন করার পথে বাধা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষকের সুষম বণ্টন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তত প্রতিটি স্কুলে চারজন শিক্ষক থাকা জরুরি; অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছে, কোথাও নেই। আবার থাকলেও কখনও প্রশিক্ষণ, কখনও প্রেষণে, কখনও বিভিন্ন সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। এরপর রয়েছে অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা। শিক্ষকের সংখ্যাল্পতা, নিষ্ঠার অভাব এবং চাকুরীতে একঘেয়েমিতার কারণে আন্তরিকতার অভাবে এ সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষা উপকরণের অভাব মানসম্মত শিক্ষাসেবার পথে বাধা। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শিক্ষানুকূল নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৩০ হওয়া উচিত। উপচে পড়া শ্রেণিকক্ষ সামাল দেয়ার দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা শিক্ষকের নেই। আধুনিক টিচিং-লার্নিং পদ্ধতির সঙ্গেও শিক্ষকের পরিচয় কম। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ কৌশল বা যতেœর চর্চা নেই। কোচিং-গাইড-টিউশনের সংস্কৃতি শিক্ষার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করছে।
২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরকে উন্নীত করা এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে দুটি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হলেও সরকার তা ২০২২ পর্যন্ত বাস্তবায়ন স্থগিত করে। শিক্ষার্থীর বয়স, শিক্ষার পরিবেশ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা প্রায় একমত যে, ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে অন্তত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের ওপর অত্যধিক পড়াশোনার চাপ তাদের স্বাভাবিক মনোজাগতিক বিকাশের পথে অন্তরায়।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। অনেকে যুক্তি দেখিয়েছেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে শিশুরা সাত বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাঠামোতে প্রবেশ করে। তৃতীয় শ্রেণির নিচে বইয়ের চাপমুক্তি, পরীক্ষার ভার লাঘব নিঃসন্দেহে একটা ভালো ভাবনা। পড়াশোনা বিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ রাখা গেলে ভালো হয়। একাডেমিক পড়াশোনা হবে স্কুলেই। জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সাল থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত পরীক্ষার বদলে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে।এ লক্ষ্যে হাতেকলমে শেখানো যায়, এমনভাবেই তৈরি হবে পাঠ্যবই। শিক্ষাক্রম পরিমার্জিত করে প্রাক-প্রাথমিক হতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এমন বই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যাবে। ২০২৫ নাগাদ কার্যক্রমটি সম্পন্ন হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
শিশুকে শুধু মেধা তালিকায় প্রথম নয়, দায়িত্বশীল নাগরিক হতে দীক্ষা দিতে হবে। প্রতিযোগিতা যেন সুস্থতার গ-ি ছাপিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরীক্ষার ভালো ফলে শিক্ষার্থী স্বীকৃতি পায়; তাতে উদ্দীপনা বাড়ে। শিশুর আস্থা বাড়ে। এ আত্মবিশ্বাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
একজন শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরণ, আবেগীয় বিকাশ, শারীরিক ফিটনেস, আচার-আচরণ, মানসিকতা-সবকিছুই শিক্ষার্থীর সক্ষমতা ও মেধার মানদ-। শিক্ষার্থীর নৈতিক, উদ্ভাবনী, স্বেচ্ছাসেবী ও মানবিক উত্তরণের বুনিয়াদ জীবনের সূচনালগ্নেই শুরু হয়। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের পথে সামাজিক বৈষম্য একটি বড় বাধা। সমাজের এ অসমতা তরুণ প্রজন্মকে অশোভন ও অনিরাপদ কর্মসংস্থানে নিয়োজিত রাখে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয় এবং বৈষম্য বাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নকে বাধাগ্রস্থ করে।
শিক্ষক সৃজনশীল, আনন্দময় ও মজার কাজের জগতে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে পারেন। এমনকি প্রযুক্তি ব্যবহার করেও সুস্থ বিনোদন ও শিক্ষা একসঙ্গেই সম্ভব হতে পারে। আগামী সময়ে শিশুকে এ প্রযুক্তির জগতে সাবলীল ও সুস্থভাবে বিচরণ করতে হবে। তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত নিরাপত্তা তাকেই নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং সে জগতে তার প্রবেশগম্যতা যাতে অনায়াস হয়ে ওঠে, সেজন্য শিক্ষককে দক্ষ ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলায় একটি সুস্থ ও উদ্যমী প্রজন্ম গড়ে তুলতে একটি প্রযুক্তিবান্ধব শিক্ষাঙ্গন দরকার। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় এ নতুন প্রজন্মই হবে এজেন্ট অব চেইঞ্জ। বিজ্ঞানমনস্ক নতুন এ তারুণ্য মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকবে, পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হবে। বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে তারা ভূমিকা রাখবে।
সমাজের চাহিদা বা রাষ্ট্রের লক্ষ্য কী- এ বিষয়ে প্রথমেই নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রের চরিত্র বা আদর্শ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও মানবিক সমাজ গঠন হয়, তবে অবশ্যই ‘পপুলিস্ট মাইন্ডসেট’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক মানসকাঠামো তৈরি কিংবা যুক্তিবাদী চিন্তাশৈলী বিকাশের পথ যাতে কোনোভাবেই রুদ্ধ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। উদ্দেশ্য বা ভাবনায় যদি কোনো অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তি না থাকে, তবে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন অপরিহার্য।
গতানুগতিক শিক্ষার বদলে যাতে শিক্ষার্থী জীবনমুখী ও কর্মমুখী দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষানীতির পথরেখায় দেশের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরম্পরা, জলবায়ু, ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাশাসিত নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে অভিযোজিত হয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার কোনো বিকল্প নেই।